Forum
24
bd

















1. First of all registration here 2. Then Click on Be a trainer or writer button 3. Collect your trainer or writer id card from trainer master 4. And create post here for earn money! 5. For trainer 100 tk minimum withdraw 6. For writer 500 tk minimum withdraw 7. Payment method Bkash Only
sakerhosen sakerhosen
Trainer

2 years ago
sakerhosen

হালদার গোষ্ঠী





হালদারগোষ্ঠী


এই পরিবারটির মধ্যে কোনোরকমের গোল বাধিবার কোনো সংগত কারণ ছিল না । অবস্থাও সচ্ছল , মানুষগুলিও কেহই মন্দ নহে কিন্তু তবুও গোল বাধিল ।

কেননা , সংগত কারণেই যদি মানুষের সব-কিছু ঘটিত তবে তো লোকালয়টা একটা অঙ্কের খাতার মতো হইত , একটু সাবধানে চলিলেই হিসাবে কোথাও কোনো ভুল ঘটিত না ; যদি বা ঘটিত সেটাকে রবার দিয়া মুছিয়া সংশোধন করিলেই চলিয়া যাইত ।

কিন্তু , মানুষের ভাগ্যদেবতার রসবোধ আছে ; গণিতশাস্ত্রে তাঁহার পাণ্ডিত্য আছে কি না জানি না , কিন্তু অনুরাগ নাই ; মানবজীবনের যোগবিয়োগের বিশুদ্ধ অঙ্ক-ফলটি উদ্ধার করিতে তিনি মনোযোগ করেন না । এইজন্য তাঁহার ব্যবস্থার মধ্যে একটা পদার্থ তিনি সংযোগ করিয়াছেন , সেটা অসংগতি । যাহা হইতে পারিত সেটাকে সে হঠাৎ আসিয়া লন্ডভন্ড করিয়া দেয় । ইহাতেই নাট্যলীলা জমিয়া উঠে , সংসারের দুই কূল ছাপাইয়া হাসিকান্নার তুফান চলিতে থাকে ।

এ ক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিল — যেখানে পদ্মবন সেখানে মত্তহস্তী আসিয়া উপস্থিত । পঙ্কের সঙ্গে পঙ্কজের একটা বিপরীত রকমের মাখামাখি হইয়া গেল; তা না হইলে এ গল্পটির সৃষ্টি হইতে পারিত না ।

যে পরিবারের কথা উপস্থিত করিয়াছি তাহার মধ্যে সব চেয়ে যোগ্য মানুষ যে বনোয়ারিলাল , তাহাতে সন্দেহ নাই । সে নিজেও তাহা বিলক্ষণ জানে এবং সেইটেতেই তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছে । যোগ্যতা এঞ্জিনের স্টীমের মতো তাহাকে ভিতর হইতে ঠেলে ; সামনে যদি সে রাস্তা পায় তো ভালোই , যদি না পায় তবে যাহা পায় তাহাকে ধাক্কা মারে ।

তাঁহার বাপ মনোহরলালের ছিল সাবেককেলে বড়োমানুষি চাল । যে সমাজ তাঁহার সেই সমাজের মাথাটিকেই আশ্রয় করিয়া তিনি তাহার শিরোভূষণ হইয়া থাকিবেন , এই তাঁহার ইচ্ছা । সুতরাং সমাজের হাত-পায়ের সঙ্গে তিনি কোনো সংস্রব রাখেন না । সাধারণ লোকে কাজকর্ম করে , চলে ফেরে ; তিনি কাজ না-করিবার ও না-চলিবার বিপুল আয়োজনটির কেন্দ্রস্থলে ধ্রুব হইয়া বিরাজ করেন ।

প্রায় দেখা যায় , এইপ্রকার লোকেরা বিনাচেষ্টায় আপনার কাছে অন্তত দুটি-একটি শক্ত এবং খাঁটি লোককে যেন চুম্বকের মতো টানিয়া আনেন । তাহার কারণ আর কিছু নয় , পৃথিবীতে একদল লোক জন্মায় সেবা করাই তাহাদের ধর্ম । তাহারা আপন প্রকৃতির চরিতার্থতার জন্যই এমন অক্ষম মানুষকে চায় যে- লোক নিজের ভার ষোলোআনাই তাহাদের উপর ছাড়িয়া দিতে পারে । এই সহজ সেবকেরা নিজের কাজে কোনো সুখ পায় না, কিন্তু আর-একজনকে নিশ্চিন্ত করা , তাহাকে সম্পূর্ণ আরামে রাখা , তাহাকে সকলপ্রকার সংকট হইতে বাঁচাইয়া চলা , লোকসমাজে তাহার সম্মানবৃদ্ধি করা , ইহাতেই তাহাদের পরম উৎসাহ । ইহারা যেন একপ্রকারের পুরুষ মা ; তাহাও নিজের ছেলের নহে , পরের ছেলের ।

মনোহরলালের যে চাকরটি আছে , রামচরণ , তাহার শরীররক্ষা ও শরীরপাতের একমাত্র লক্ষ্য বাবুর দেহ রক্ষা করা । যদি সে নিশ্বাস লইলে বাবুর নিশ্বাস লইবার প্রয়োজনটুকু বাঁচিয়া যায় তাহা হইলে সে অহোরাত্র কামারের হাপরের মতো হাঁপাইতে রাজি আছে । বাহিরে লোকে অনেক সময় ভাবে , মনোহরলাল বুঝি তাঁহার সেবককে অনাবশ্যক খাটাইয়া অন্যায় পীড়ন করিতেছেন । কেননা , হাত হইতে গুড়গুড়ির নলটা হয়তো মাটিতে পড়িয়াছে , সেটাকে তোলা কঠিন কাজ নহে , অথচ সেজন্য ডাক দিয়া অন্য ঘর হইতে রামচরণকে দৌড় করানো নিতান্ত বিসদৃশ বলিয়াই বোধ হয় ; কিন্তু এই-সকল ভূরি ভূরি অনাবশ্যক ব্যাপারে নিজেকে অত্যাবশ্যক করিয়া তোলাতেই রামচরণের প্রভূত আনন্দ ।
যেমন তাঁহার রামচরণ , তেমনি তাঁহার আর-একটি অনুচর নীলকণ্ঠ । বিষয়রক্ষার ভার এই নীলকণ্ঠের উপর । বাবুর প্রসাদপরিপুষ্ট রামচরণটি দিব্য সুচিক্কণ , কিন্তু নীলকণ্ঠের দেহে তাহার অস্থিকঙ্কালের উপর কোনোপ্রকার আব্রু নাই বলিলেই হয় । বাবুর ঐশ্বর্যভাণ্ডারের দ্বারে সে মূর্তিমান দুর্ভিক্ষের মতো পাহারা দেয় । বিষয়টা মনোহরলালের কিন্তু তাহার মমতাটা সম্পূর্ণ নীলকণ্ঠের ।

নীলকণ্ঠের সঙ্গে বনোয়ারিলালের খিটিমিটি অনেকদিন হইতে বাধিয়াছে । মনে করো, বাপের কাছে দরবার করিয়া বনোয়ারি বড়োবউয়ের জন্য একটা নূতন গহনা গড়াইবার হুকুম আদায় করিয়াছে। তাহার ইচ্ছা , টাকাটা বাহির করিয়া লইয়া নিজের মনোমত করিয়া জিনিসটা ফরমাশ করে । কিন্তু , সে হইবার জো নাই। খরচপত্রের সমস্ত কাজই নীলকণ্ঠের হাত দিয়াই হওয়া চাই। তাহার ফল হইল এই, গহনা হইল বটে, কিন্তু কাহারো মনের মতো হইল না । বনোয়ারির নিশ্চয় বিশ্বাস হইল, স্যাকরার সঙ্গে নীলকণ্ঠের ভাগবাটোয়ারা চলে। কড়া লোকের শত্রুর অভাব নাই। ঢের লোকের কাছে বনোয়ারি ঐ কথাই শুনিয়া আসিয়াছে যে, নীলকণ্ঠ অন্যকে যে পরিমাণে বঞ্চিত করিতেছে নিজের ঘরে তাহার ততোধিক পরিমাণে সঞ্চিত হইয়া উঠিতেছে।

অথচ দুই পক্ষে এই যে সব বিরোধ জমা হইয়া উঠিয়াছে তাহা সামান্য পাঁচ-দশ টাকা লইয়া । নীলকণ্ঠের বিষয়বুদ্ধির অভাব নাই — এ কথা তাহার পক্ষে বুঝা কঠিন নহে যে , বনোয়ারির সঙ্গে বনাইয়া চলিতে না পারিলে কোনো-না-কোনো দিন তাহার বিপদ ঘটিবার সম্ভাবনা । কিন্তু , মনিবের ধন সম্বন্ধে নীলকণ্ঠের একটা কৃপণতার বায়ু আছে । সে যেটাকে অন্যায্য মনে করে মনিবের হুকুম পাইলেও কিছুতেই তাহা সে খরচ করিতে পারে না ।

এ দিকে বনোয়ারিরই প্রায়ই অন্যায্য খরচের প্রয়োজন ঘটিতেছে । পুরুষের অনেক অন্যায্য ব্যাপারের মূলে যে কারণ থাকে সেই কারণটি এখানেও খুব প্রবলভাবে বর্তমান । বনোয়ারির স্ত্রী কিরণলেখার সৌন্দর্য সম্বন্ধে নানা মত থাকিতে পারে , তাহা লইয়া আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন । তাহার মধ্যে যে মতটি বনোয়ারির , বর্তমান প্রসঙ্গে একমাত্র সেইটেই কাজের । বস্তুত স্ত্রীর প্রতি বনোয়ারির মনের যে পরিমাণ টান সেটাকে বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা বাড়াবাড়ি বলিয়াই মনে করে । অর্থাৎ , তাহারা নিজের স্বামীর কাছ হইতে যতটা আদর চায় অথচ পায় না , ইহা ততটা ।

কিরণলেখার বয়স যতই হউক চেহারা দেখিলে মনে হয় ছেলেমানুষটি । বাড়ির বড়োবউয়ের যেমনতর গিন্নিবান্নি ধরনের আকৃতি-প্রকৃতি হওয়া উচিত সে তাহা একেবারেই নহে । সবসুদ্ধ জড়াইয়া সে যেন বড়ো স্বল্প ।

বনোয়ারি তাহাকে আদর করিয়া অণু বলিয়া ডাকিত । যখন তাহাতেও কুলাইত না তখন বলিত পরমাণু । রসায়নশাস্ত্রে যাঁহাদের বিচক্ষণতা আছে তাঁহারা জানেন , বিশ্বঘটনায় অণুপরমাণুগুলির শক্তি বড়ো কম নয় ।

কিরণ কোনোদিন স্বামীর কাছে কিছুর জন্য আবদার করে নাই । তাহার এমন একটি উদাসীন ভাব , যেন তাহার বিশেষ কিছুতে প্রয়োজন নাই । বাড়িতে তাহার অনেক ঠাকুরঝি , অনেক ননদ ; তাহাদিগকে লইয়া সর্বদাই তাহার সমস্ত মন ব্যাপৃত; নবযৌবনের নবজাগ্রত প্রেমের মধ্যে যে একটা নির্জন তপস্যা আছে তাহাতে তাহার তেমন প্রয়োজন-বোধ নাই । এইজন্য বনোয়ারির সঙ্গে ব্যবহারে তাহার বিশেষ একটা আগ্রহের লক্ষণ দেখা যায় না । যাহা সে বনোয়ারির কাছ হইতে পায় তাহা সে শান্তভাবে গ্রহণ করে , অগ্রসর হইয়া কিছু চায় না । তাহার ফল হইয়াছে এই যে , স্ত্রীটি কেমন করিয়া খুশি হইবে সেই কথা বনোয়ারিকে নিজে ভাবিয়া বাহির করিতে হয় । স্ত্রী যেখানে নিজের মুখে ফরমাশ করে সেটাকে তর্ক করিয়া কিছু-না-কিছু খর্ব করা সম্ভব হয় , কিন্তু নিজের সঙ্গে তো দর-কষাকষি চলে না । এমন স্থলে অযাচিত দানে যাচিত দানের চেয়ে খরচ বেশি পড়িয়া যায় ।

তাহার পরে স্বামীর সোহাগের উপহার পাইয়া কিরণ যে কতখানি খুশি হইল তাহা ভালো করিয়া বুঝিবার জো নাই । এ সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলে সে বলে — বেশ। ভালো। কিন্তু , বনোয়ারির মনের খটকা কিছুতেই মেটে না ; ক্ষণে ক্ষণে তাহার মনে হয় , হয়তো পছন্দ হয় নাই । কিরণ স্বামীকে ঈষৎ ভর্ৎসনা করিয়া বলে , “ তোমার ঐ স্বভাব। কেন এমন খুঁতখুঁত করছ । কেন , এ তো বেশ হয়েছে । ”
বনোয়ারি পাঠ্যপুস্তকে পড়িয়াছে — সন্তোষগুণটি মানুষের মহৎ গুণ। কিন্তু, স্ত্রীর স্বভাবে এই মহৎ গুণটি তাহাকে পীড়া দেয়। তাহার স্ত্রী তো তাহাকে কেবলমাত্র সন্তুষ্ট করে নাই, অভিভূত করিয়াছে, সেও স্ত্রীকে অভিভূত করিতে চায়। তাহার স্ত্রীকে তো বিশেষ কোনো চেষ্টা করিতে হয় না — যৌবনের লাবণ্য আপনি উছলিয়া পড়ে , সেবার নৈপুণ্য আপনি প্রকাশ হইতে থাকে; কিন্তু পুরুষের তো এমন সহজ সুযোগ নয়; পৌরুষের পরিচয় দিতে হইলে তাহাকে কিছু-একটা করিয়া তুলিতে হয় । তাহার যে বিশেষ একটা শক্তি আছে ইহা প্রমাণ করিতে না পারিলে পুরুষের ভালোবাসা ম্লান হইয়া থাকে। আর-কিছু না ‘ ও যদি থাকে , ধন যে একটা শক্তির নিদর্শন, ময়ূরের পুচ্ছের মতো স্ত্রীর কাছে সেই ধনের সমস্ত বর্ণচ্ছটা বিস্তার করিতে পারিলে তাহাতে মন সান্ত্বনা পায় । নীলকণ্ঠ বনোয়ারির প্রেমনাট্যলীলার এই আয়োজনটাতে বারংবার ব্যাঘাত ঘটাইয়াছে। বনোয়ারি বাড়ির বড়োবাবু , তবু কিছুতে তাহার কর্তৃত্ব নাই , কর্তার প্রশ্রয় পাইয়া ভৃত্য হইয়া নীলকণ্ঠ তাহার উপরে আধিপত্য করে, ইহাতে বনোয়ারির যে অসুবিধা ও অপমান সেটা আর-কিছুর জন্য তত নহে যতটা পঞ্চশরের তুণে মনের মতো শর জোগাইবার অক্ষমতাবশত।

একদিন এই ধনসম্পদে তাহারই অবাধ অধিকার তো জন্মিবে । কিন্তু যৌবন কি চিরদিন থাকিবে ? বসন্তের রঙিন পেয়ালায় তখন এ সুধারস এমন করিয়া আপনা-আপনি ভরিয়া উঠিবে না ; টাকা তখন বিষয়ীর টাকা হইয়া খুব শক্ত হইয়া জমিবে , গিরিশিখরের তুষারসংঘাতের মতো, তাহাতে কথায় কথায় অসাবধানের অপব্যয়ের ঢেউ খেলিতে থাকিবে না । টাকার দরকার তো এখনই , যখন আনন্দে তাহা নয়-ছয় করিবার শক্তি নষ্ট হয় নাই ।

বনোয়ারির প্রধান শখ তিনটি — কুস্তি , শিকার এবং সংস্কৃতচর্চা । তাহার খাতার মধ্যে সংস্কৃত উদ্ভটকবিতা একেবারে বোঝাই করা । বাদলার দিনে , জ্যোৎস্নারাত্রে , দক্ষিনা হাওয়ায়, সেগুলি বড়ো কাজে লাগে । সুবিধা এই , নীলকণ্ঠ এই কবিতাগুলির অলংকারবাহুল্যকে খর্ব করিতে পারে না । অতিশয়োক্তি যতই অতিশয় হউক , কোনো খাতাঞ্চি-সেরেস্তায় তাহার জন্য জবাবদিহি নাই । কিরণের কানের সোনায় কার্পণ্য ঘটে কিন্তু তাহার কানের কাছে যে মন্দাক্রান্তা গুঞ্জরিত হয় তাহার ছন্দে একটি মাত্রাও কম পড়ে না এবং তাহার ভাবে কোনো মাত্রা থাকে না বলিলেই হয় ।

লম্বাচওড়া পালোয়নের চেহারা বনোয়ারির । যখন সে রাগ করে তখন তাহার ভয়ে লোকে অস্থির । কিন্তু , এই জোয়ান লোকটির মনের ভিতরটা ভারি কোমল । তাহার ছোটো ভাই বংশীলাল যখন ছোটো ছিল তখন সে তাহাকে মাতৃস্নেহে লালন করিয়াছে । তাহার হৃদয়ে যেন একটি লালন করিবার ক্ষুধা আছে ।

তাহার স্ত্রীকে সে যে ভলোবাসে তাহার সঙ্গে এই জিনিসটিও জড়িত , এই লালন করিবার ইচ্ছা । কিরণলেখা তরুচ্ছায়ার মধ্যে পথহারা রশ্মিরেখাটুকুর মতোই ছোটো , ছোটো বলিয়াই সে তাহার স্বামীর মনে ভারি একটা দরদ জাগাইয়া রাখিয়াছে ; এই স্ত্রীকে বসনে ভূষণে নানারকম করিয়া সাজাইয়া দেখিতে তাহার বড়ো আগ্রহ । তাহা ভোগ করিবার আনন্দ নহে , তাহা রচনা করিবার আনন্দ ; তাহা এককে বহু করিবার আনন্দ , কিরণলেখাকে নানা বর্ণে নানা আবরণে নানারকম করিয়া দেখিবার আনন্দ ।

কিন্তু , কেবলমাত্র সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করিয়া বনোয়ারির এই শখ কোনোমতেই মিটিতেছে না । তাহার নিজের মধ্যে একটি পুরুষোচিত প্রভুশক্তি আছে তাহাও প্রকাশ করিতে পারিল না , আর প্রেমের সামগ্রীকে নানা উপকরণে ঐশ্বর্যবান করিয়া তুলিবার যে ইচ্ছা তাহাও তার পূর্ণ হইতেছে না ।

এমনি করিয়াই এই ধনীর সন্তান তাহার মানমর্যাদা , তাহার সুন্দরী স্ত্রী , তাহার ভরা যৌবন — সাধারণত লোকে যাহা কামনা করে তাহার সমস্ত লইয়াও সংসারে একদিন একটা উৎপাতের মতো হইয়া উঠিল ।
সুখদা মধুকৈবর্তের স্ত্রী , মনোহরলালের প্রজা । সে একদিন অন্তঃপুরে আসিয়া কিরণলেখার পা জড়াইয়া ধরিয়া কান্না জুড়িয়া দিল । ব্যাপারটা এই — বছর কয়েক পূর্বে নদীতে বেড়জাল ফেলিবার আয়োজন-উপলক্ষে অন্যান্য বারের মতো জেলেরা মিলিয়া একযোগে খৎ লিখিয়া মনোহরলালের কাছারিতে হাজার টাকা ধার লইয়াছিল । ভালোমত মাছ পড়িলে সুদে আসলে টাকা শোধ করিয়া দিবার কোনো অসুবিধা ঘটে না ; এইজন্য উচ্চ সুদের হারে টাকা লইতে ইহারা চিন্তামাত্র করে না । সে বৎসর তেমন মাছ পড়িল না, এবং ঘটনাক্রমে উপরি উপরি তিন বৎসর নদীর বাঁকে মাছ এত কম আসিল যে জেলেদের খরচ পোষাইল না , অধিকন্তু তাহারা ঋণের জালে বিপরীত রকম জড়াইয়া পড়িল । যে-সকল জেলে ভিন্ন এলেকার তাহাদের আর দেখা পাওয়া যায় না ; কিন্তু , মধুকৈবর্ত ভিটাবাড়ির প্রজা , তাহার পলাইবার জো নাই বলিয়া সমস্ত দেনার দায় তাহার উপরেই চাপিয়াছে । সর্বনাশ হইতে রক্ষা পাইবার অনুরোধ লইয়া সে কিরণের শরণাপন্ন হইয়াছে । কিরণের শাশুড়ির কাছে গিয়া কোনো ফল নাই তাহা সকলেই জানে ; কেননা, নীলকণ্ঠের ব্যবস্থায় কেহ যে আঁচড়টুকু কাটিতে পারে এ কথা তিনি কল্পনা করিতেও পারেন না । নীলকণ্ঠের প্রতি বনোয়ারির খুব একটা আক্রোশ আছে জানিয়াই মধুকৈবর্ত তাহার স্ত্রীকে কিরণের কাছে পাঠাইয়াছে ।

বনোয়ারি যতই রাগ এবং যতই আস্ফালন করুক , কিরণ নিশ্চয় জানে যে , নীলকণ্ঠের কাজের উপর হস্তক্ষেপ করিবার কোনো অধিকার তাহার নাই । এইজন্য কিরণ সুখদাকে বার বার করিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিয়া বলিল , “ বাছা , কী করব বলো । জানই তো এতে আমাদের কোনো হাত নেই । কর্তা আছেন , মধুকে বলো , তাঁকে গিয়ে ধরুক । ”

সে চেষ্টা তো পূর্বেই হইয়াছে । মনোহরলালের কাছে কোনো বিষয়ে নালিশ উঠিলেই তিনি তাহার বিচারের ভার নীলকণ্ঠের ‘ পরেই অর্পণ করেন , কখনোই তাহার অন্যথা হয় না । ইহাতে বিচারপ্রার্থীর বিপদ আরো বাড়িয়া উঠে । দ্বিতীয়বার কেহ যদি তাঁহার কাছে আপিল করিতে চায় তাহা হইলে কর্তা রাগিয়া আগুন হইয়া উঠেন — বিষয়কর্মের বিরক্তিই যদি তাঁহাকে পোহাইতে হইল তবে বিষয় ভোগ করিয়া তাঁহার সুখ কী।

সুখদা যখন কিরণের কাছে কান্নাকাটি করিতেছে তখন পাশের ঘরে বসিয়া বনোয়ারি তাহার বন্দুকের চোঙে তেল মাখাইতেছিল । বনোয়ারি সব কথাই শুনিল । কিরণ করুণকণ্ঠে যে বার বার করিয়া বলিতেছিল যে তাহারা ইহার কোনো প্রতিকার করিতে অক্ষম , সেটা বনোয়ারির বুকে শেলের মতো বিঁধিল ।

সেদিন মাঘীপূর্ণিমা ফাল্গুনের আরম্ভে আসিয়া পড়িয়াছে । দিনের বেলাকার গুমট ভাঙিয়া সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ একটা পাগলা হাওয়া মাতিয়া উঠিল । কোকিল তো ডাকিয়া ডাকিয়া অস্থির ; বার বার এক সুরের আঘাতে সে কোথাকার কোন্‌ ঔদাসীন্যকে বিচলিত করিবার চেষ্টা করিতেছে । আর , আকাশে ফুলগন্ধের মেলা বসিয়াছে , যেন ঠেলাঠেলি ভিড়; জানলার ঠিক পাশেই অন্তঃপুরের বাগান হইতে মুচুকুন্দফুলের গন্ধ বসন্তের আকাশে নিবিড় নেশা ধরাইয়া দিল । কিরণ সেদিন লট্‌কানের-রঙ-করা একখানি শাড়ি এবং খোঁপায় বেলফুলের মালা পরিয়াছে । এই দম্পতির চিরনিয়ম অনুসারে সেদিন বনোয়ারির জন্যও ফাল্গুন-ঋতুযাপনের উপযোগী একখানি লট্‌কানে-রঙিন চাদর ও বেলফুলের গোড়েমালা প্রস্তুত । রাত্রির প্রথম প্রহর কাটিয়া গেল তবু বনোয়ারির দেখা নাই । যৌবনের ভরা পেয়ালাটি আজ তাহার কাছে কিছুতেই রুচিল না । প্রেমের বৈকুণ্ঠলোকে এতবড়ো কুণ্ঠা লইয়া সে প্রবেশ করিবে কেমন করিয়া । মধুকৈবর্তের দুঃখ দূর করিবার ক্ষমতা তাহার নাই , সে ক্ষমতা আছে নীলকণ্ঠের! এমন কাপুরুষের কণ্ঠে পরাইবার জন্য মালা কে গাঁথিয়াছে ।

প্রথমেই সে তাহার বাহিরের ঘরে নীলকণ্ঠকে ডাকাইয়া আনিল এবং দেনার দায়ে মধুকৈবর্তকে নষ্ট করিতে নিষেধ করিল । নীলকণ্ঠ কহিল , মধুকে যদি প্রশ্রয় দেওয়া হয় তাহা হইলে এই তামাদির মুখে বিস্তর টাকা বাকি পড়িবে ; সকলেই ওজর করিতে আরম্ভ করিবে। বনোয়ারি তর্কে যখন পারিল না তখন যাহা মুখে আসিল গাল দিতে লাগিল। বলিল, ছোটোলোক। নীলকণ্ঠ কহিল , “ ছোটোলোক না হইলে বড়োলোকের শরণাপন্ন হইব কেন। ” বলিল, চোর । নীলকণ্ঠ বলিল, “সে তো বটেই , ভগবান যাহাকে নিজের কিছুই দেন নাই, পরের ধনেই তো সে প্রাণ বাঁচায়। ” সকল গালিই সে মাথায় করিয়া লইল; শেষকালে বলিল, “ উকিলবাবু বসিয়া আছেন , তাঁহার সঙ্গে কাজের কথাটা সারিয়া লই । যদি দরকার বোধ করেন তো আবার আসিব। ”
বনোয়ারি ছোটো ভাই বংশীকে নিজের দলে টানিয়া তখনই বাপের কাছে যাওয়া স্থির করিল । সে জানিত, একলা গেলে কোনো ফল হইবে না, কেননা , এই নীলকণ্ঠকে লইয়াই তাহার বাপের সঙ্গে পূর্বেই তাহার খিটিমিটি হইয়াছে। বাপ তাহার উপর বিরক্ত হইয়াই আছেন। একদিন ছিল যখন সকলেই মনে করিত, মনোহরলাল তাঁহার বড়ো ছেলেকেই সব চেয়ে ভালোবাসেন। কিন্তু , এখন মনে হয়, বংশীর উপরেই তাঁহার পক্ষপাত। এইজন্যই বনোয়ারি বংশীকেও তাহার নালিশের পক্ষভুক্ত করিতে চাহিল।

বংশী , যাহাকে বলে , অত্যন্ত ভালো ছেলে । এই পরিবারের মধ্যে সে-ই কেবল দুটো এক্‌জামিন পাস করিয়াছে । এবার সে আইনের পরীক্ষা দিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে । দিনরাত জাগিয়া পড়া করিয়া করিয়া তাহার অন্তরের দিকে কিছু জমা হইতেছে কি না অন্তর্যামী জানেন কিন্তু শরীরের দিকে খরচ ছাড়া আর কিছুই নাই ।

এই ফাল্গুনের সন্ধ্যায় তাহার ঘরে জানলা বন্ধ । ঋতুপরিবর্তনের সময়টাকে তাহার ভারি ভয় । হাওয়ার প্রতি তাহার শ্রদ্ধামাত্র নাই । টেবিলের উপর একটা কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বলিতেছে। কতক বই মেজের উপরে চৌকির পাশে রাশীকৃত , কতক টেবিলের উপরে ; দেয়ালে কুলুঙ্গিতে কতকগুলি ঔষধের শিশি ।

বনোয়ারির প্রস্তাবে সে কোনোমতেই সম্মত হইল না । বনোয়ারি রাগ করিয়া গর্জিয়া উঠিল , “ তুই নীলকণ্ঠকে ভয় করিস! ” বংশী তাহার কোনো উত্তর না দিয়া চুপ করিয়া রহিল । বস্তুতই নীলকণ্ঠকে অনুকূল রাখিবার জন্য তাহার সর্বদাই চেষ্টা । সে প্রায় সমস্ত বৎসর কলিকাতার বাসাতেই কাটায় ; সেখানে বরাদ্দ টাকার চেয়ে তাহার বেশি দরকার হইয়াই পড়ে । এই সূত্রে নীলকণ্ঠকে প্রসন্ন রাখাটা তাহার অভ্যস্ত ।

বংশীকে ভীরু , কাপুরুষ , নীলকণ্ঠের চরণ-চারণ-চক্রবর্তী বলিয়া খুব একচোট গালি দিয়া বনোয়ারি একলাই বাপের কাছে গিয়া উপস্থিত । মনোহরলাল তাঁহাদের বাগানে দিঘির ঘাটে তাঁহার নধর শরীরটি উদ্ঘাটন করিয়া আরামে হাওয়া খাইতেছেন । পারিষদগণ কাছে বসিয়া কলিকাতার বারিস্টারের জেরায় জেলাকোর্টে অপর পল্লীর জমিদার অখিল মজুমদার যে কিরূপ নাকাল হইয়াছিল তাহারই কাহিনী কর্তাবাবুর শ্রুতিমধুর করিয়া রচনা করিতেছিল । সেদিন বসন্তসন্ধ্যার সুগন্ধ বায়ু-সহযোগে সেই বৃত্তান্তটি তাঁহার কাছে অত্যন্ত রমণীয় হইয়া উঠিয়াছিল ।

হঠাৎ বনোয়ারি তাহার মাঝখানে পড়িয়া রসভঙ্গ করিয়া দিল । ভূমিকা করিয়া নিজের বক্তব্য কথাটা ধীরে ধীরে পাড়িবার মতো অবস্থা তাহার ছিল না । সে একেবারে গলা চড়াইয়া শুরু করিয়া দিল , নীলকণ্ঠের দ্বারা তাহাদের ক্ষতি হইতেছে । সে চোর , সে মনিবের টাকা ভাঙিয়া নিজের পেট ভরিতেছে । কথাটার কোনো প্রমাণ নাই এবং তাহা সত্যও নহে । নীলকণ্ঠের দ্বারা বিষয়ের উন্নতি হইয়াছে , এবং সে চুরিও করে না । বনোয়ারি মনে করিয়াছিল , নীলকণ্ঠের সৎস্বভাবের প্রতি অটল বিশ্বাস আছে বলিয়াই কর্তা সকল বিষয়েই তাহার ‘ পরে এমন চোখ বুজিয়া নির্ভর করেন । এটা তাহার ভ্রম । মনোহরলালের মনে নিশ্চয় ধারণা যে নীলকণ্ঠ সুযোগ পাইলে চুরি করিয়া থাকে । কিন্তু, সেজন্য তাহার প্রতি তাঁহার কোনো অশ্রদ্ধা নাই । কারণ , আবহমান কাল এমনি ভাবেই সংসার চলিয়া আসিতেছে । অনুচরগণের চুরির উচ্ছিষ্টেই তো চিরকাল বড়োঘর পালিত । চুরি করিবার চাতুরী যাহার নাই , মনিবের বিষয়রক্ষা করিবার বুদ্ধিই বা তাহার জোগাইবে কোথা হইতে । ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে দিয়া তো জমিদারির কাজ চলে না । মনোহর অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিয়া কহিলেন , “ আচ্ছা , আচ্ছা , নীলকণ্ঠ কী করে না-করে সে কথা তোমাকে ভাবিতে হইবে না । ” সেই সঙ্গে ইহাও বলিলেন , “ দেখো দেখি , বংশীর তো কোনো বালাই নাই । সে কেমন পড়াশুনা করিতেছে। ঐ ছেলেটা তবু একটু মানুষের মতো । ”
ইহার পরে অখিল মজুমদারের দুর্গতিকাহিনীতে আর রস জমিল না । সুতরাং , মনোহরলালের পক্ষে সেদিন বসন্তের বাতাস বৃথা বহিল এবং দিঘির কালো জলের উপর চাঁদের আলোর ঝক্‌ঝক্‌ করিয়া উঠিবার কোনো উপযোগিতা রহিল না । সেদিন সন্ধ্যাটা কেবল বৃথা হয় নাই বংশী এবং নীলকণ্ঠের কাছে । জানলা বন্ধ করিয়া বংশী অনেক রাত পর্যন্ত পড়িল এবং উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া করিয়া নীলকণ্ঠ অর্ধেক রাত কাটাইয়া দিল ।

কিরণ ঘরের প্রদীপ নিবাইয়া দিয়া জানলার কাছে বসিয়া । কাজকর্ম আজ সে সকাল-সকাল সারিয়া লইয়াছে। রাত্রের আহার বাকি, কিন্তু এখনো বনোয়ারি খায় নাই , তাই সে অপেক্ষা করিতেছে । মধুকৈবর্তের কথা তাহার মনেও নাই । বনোয়ারি যে মধুর দুঃখের কোনো প্রতিকার করিতে পারে না , এ সম্বন্ধে কিরণের মনে ক্ষোভের লেশমাত্র ছিল না । তাহার স্বামীর কাছ হইতে কোনোদিন সে কোনো বিশেষ ক্ষমতার পরিচয় পাইবার জন্য উৎসুক নহে । পরিবারের গৌরবেই তাহার স্বামীর গৌরব । তাহার স্বামী তাহার শ্বশুরের বড়ো ছেলে, ইহার চেয়ে তাহাকে যে আরো বড়ো হইতে হইবে , এমন কথা কোনোদিন তাহার মনেও হয় নাই । ইহারা যে গোঁসাইগঞ্জের সুবিখ্যাত হালদার-বংশ!

বনোয়ারি অনেক রাত্রি পর্যন্ত বাহিরের বারান্ডায় পায়চারি সমাধা করিয়া ঘরে আসিল । সে ভুলিয়া গিয়াছে যে , তাহার খাওয়া হয় নাই । কিরণ যে তাহার অপেক্ষায় না-খাইয়া বসিয়া আছে এই ঘটনাটা সেদিন যেন তাহাকে বিশেষ করিয়া আঘাত করিল । কিরণের এই কষ্টস্বীকারের সঙ্গে তাহার নিজের অকর্মণ্যতা যেন খাপ খাইল না । অন্নের গ্রাস তাহার গলায় বাধিয়া যাইবার জো হইল । বনোয়ারি অত্যন্ত উত্তেজনার সহিত স্ত্রীকে বলিল , “ যেমন করিয়া পারি মধুকৈবর্তকে আমি রক্ষা করিব । ” কিরণ তাহার এই অনাবশ্যক উগ্রতায় বিস্মিত হইয়া কহিল , “ শোনো একবার! তুমি তাহাকে বাঁচাইবে কেমন করিয়া । ”

মধুর দেনা বনোয়ারি নিজে শোধ করিয়া দিবে এই তাহার পণ , কিন্তু বনোয়ারির হাতে কোনোদিন তো টাকা জমে না । স্থির করিল , তাহার তিনটে ভালো বন্দুকের মধ্যে একটা বন্দুক এবং একটা দামি হীরার আংটি বিক্রয় করিয়া সে অর্থ সংগ্রহ করিবে । কিন্তু , গ্রামে এ-সব জিনিসের উপযুক্ত মূল্য জুটিবে না এবং বিক্রয়ের চেষ্টা করিলে চারি দিকে লোকে কানাকানি করিবে । এইজন্য কোনো-একটা ছুতা করিয়া বনোয়ারি কলিকাতায় চলিয়া গেল । যাইবার সময় মধুকে ডাকিয়া আশ্বাস দিয়া গেল , তাহার কোনো ভয় নাই ।

এ দিকে বনোয়ারির শরণাপন্ন হইয়াছে বুঝিয়া , নীলকণ্ঠ মধুর উপরে রাগিয়া আগুন হইয়া উঠিয়াছে । পেয়াদার উৎপীড়নে কৈবর্তপাড়ার আর মানসম্ভ্রম থাকে না ।

কলিকাতা হইতে বনোয়ারি যেদিন ফিরিয়া আসিল সেই দিনই মধুর ছেলে স্বরূপ হাঁপাইতে হাঁপাইতে ছুটিয়া আসিয়া একেবারে বনোয়ারির পা জড়াইয়া ধরিয়া হাউহাউ করিয়া কান্না জুড়িয়া দিল । “ কী রে কী , ব্যাপারখানা কী । ” স্বরূপ বলিল, তাহার বাপকে নীলকণ্ঠ কাল রাত্রি হইতে কাছারিতে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছে । বনোয়ারির সর্বশরীর রাগে কাঁপিতে লাগিল । কহিল , “ এখনি গিয়া থানায় খবর দিয়া আয় গে । ”

কী সর্বনাশ। থানায় খবর! নীলকণ্ঠের বিরুদ্ধে ! তাহার পা উঠিতে চায় না । শেষকালে বনোয়ারির তাড়নায় থানায় গিয়া সে খবর দিল । পুলিস হঠাৎ কাছারিতে আসিয়া বন্ধনদশা হইতে মধুকে খালাস করিল এবং নীলকণ্ঠ ও কাছারির কয়েকজন পেয়াদাকে আসামী করিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চালান করিয়া দিল ।

মনোহর বিষম ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেন । তাঁহার মকদ্দমার মন্ত্রীরা ঘুষের উপলক্ষ করিয়া পুলিসের সঙ্গে ভাগ করিয়া টাকা লুটিতে লাগিল । কলিকাতা হইতে এক বারিস্টার আসিল , সে একেবারে কাঁচা , নূতন-পাস-করা । সুবিধা এই , যত ফি তাহার নামে খাতায় খরচ পড়ে তত ফি তাহার পকেটে উঠে না। ও দিকে মধুকৈবর্তের পক্ষে জেলা-আদালতের একজন মাতব্বর উকিল নিযুক্ত হইল । কে যে তাহার খরচ জোগাইতেছে বোঝা গেল না। নীলকণ্ঠের ছয় মাস মেয়াদ হইল । হাইকোর্টের আপিলেও তাহাই বহাল রহিল ।
ঘড়ি এবং বন্দুকটা যে উপযুক্ত মূল্যে বিক্রয় হইয়াছে তাহা ব্যর্থ হইল না — আপাতত মধু বাঁচিয়া গেল এবং নীলকণ্ঠের জেল হইল । কিন্তু , এই ঘটনার পরে মধু তাহার ভিটায় টিঁকিবে কী করিয়া। বনোয়ারি তাহাকে আশ্বাস দিয়া কহিল , “ তুই থাক্‌ , তোর কোনো ভয় নাই । ” কিসের জোরে যে আশ্বাস দিল তাহা সেই জানে — বোধ করি , নিছক নিজের পৌরুষের স্পর্ধায় ।

বনোয়ারি যে এই ব্যাপারের মূলে আছে তাহা সে লুকাইয়া রাখিতে বিশেষ চেষ্টা করে নাই । কথাটা প্রকাশ হইল ; এমন-কি , কর্তার কানেও গেল । তিনি চাকরকে দিয়া বলিয়া পাঠাইলেন , “ বনোয়ারি যেন কদাচ আমার সম্মুখে না আসে । ” বনোয়ারি পিতার আদেশ অমান্য করিল না ।

কিরণ তাহার স্বামীর ব্যবহার দেখিয়া অবাক । এ কী কাণ্ড । বাড়ির বড়োবাবু — বাপের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ! তার উপরে নিজেদের আমলাকে জেলে পাঠাইয়া বিশ্বের লোকের কাছে নিজের পরিবারের মাথা হেঁট করিয়া দেওয়া! তাও এই এক সামান্য মধুকৈবর্তকে লইয়া!

অদ্ভুত বটে! এ বংশে কতকাল ধরিয়া কত বড়োবাবু জন্মিয়াছে এবং কোনোদিন নীলকণ্ঠেরও অভাব নাই । নীলকণ্ঠেরা বিষয়ব্যবস্থার সমস্ত দায় নিজেরা লইয়াছে আর বড়োবাবুরা সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্টভাবে বংশগৌরব রক্ষা করিয়াছে । এমন বিপরীত ব্যাপার তো কোনোদিন ঘটে নাই।

আজ এই পরিবারের বড়োবাবুর পদের অবনতি ঘটাতে বড়োবউয়ের সম্মানে আঘাত লাগিল । ইহাতে এতদিন পরে আজ স্বামীর প্রতি কিরণের যথার্থ অশ্রদ্ধার কারণ ঘটিল । এতদিন পরে তাহার বসন্তকালের লট্‌কানে- রঙের শাড়ি এবং খোঁপার বেলফুলের মালা লজ্জায় ম্লান হইয়া গেল ।

কিরণের বয়স হইয়াছে অথচ সন্তান হয় নাই । এই নীলকণ্ঠই একদিন কর্তার মত করাইয়া পাত্রী দেখিয়া বনোয়ারির আর-একটি বিবাহ প্রায় পাকাপাকি স্থির করিয়াছিল । বনোয়ারি হালদারবংশের বড়ো ছেলে , সকল কথার আগে এ কথা তো মনে রাখিতে হইবে । সে অপুত্রক থাকিবে , ইহা তো হইতেই পারে না । এই ব্যাপারে কিরণের বুক দুর‌্দুর্ করিয়া কাঁপিয়া উঠিয়াছিল । কিন্তু , ইহা সে মনে মনে না স্বীকার করিয়া থাকিতে পারে নাই যে , কথাটা সংগত । তখনো সে নীলকণ্ঠের উপরে কিছুমাত্র উপরে কিছুমাত্র রাগ করে নাই , সে নিজের ভাগ্যকেই দোষ দিয়াছে । তাহার স্বামী যদি নীলকণ্ঠের রাগিয়া মারিতে না যাইত এবং বিবাহসম্বন্ধ ভাঙিয়া দিয়া পিতামাতার সঙ্গে রাগারাগি না করিত তবে কিরণ সেটাকে অন্যায় মনে করিত না । এমন-কি , বনোয়ারি যে তাহার বংশের কথা ভাবিল না , ইহাতে অতি গোপনে কিরণের মনে বনোয়ারির পৌরুষের প্রতি একটু অশ্রদ্ধাই হইয়াছিল । বড়ো ঘরের দাবি কি সামান্য দাবি । তাহার যে নিষ্ঠুর হইবার অধিকার আছে । তাহার কাছে কোনো তরুণী স্ত্রীর কিম্বা কোনো দুঃখী কৈবর্তের সুখদুঃখের কতটুকুই বা মূল্য!

সাধারণত যাহা ঘটিয়া থাকে এক-একবার তাহা না ঘটিলে কেহই তাহা ক্ষমা করিতে পারে না , এ কথা বনোয়ারি কিছুতেই বুঝিতে পারিল না । সম্পূর্ণরূপে এ বাড়ির বড়োবাবু হওয়াই তাহার উচিত ছিল ; অন্য কোনো প্রকারের উচিত-অনুচিত চিন্তা করিয়া এখানকার ধারাবাহিকতা নষ্ট করা যে তাহার অকর্তব্য , তাহা সে ছাড়া সকলেরই কাছে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ।

এ লইয়া কিরণ তাহার দেবরের কাছে কত দুঃখই করিয়াছে । বংশী বুদ্ধিমান ; তাহার খাওয়া হজম হয় না এবং একটু হাওয়া লাগিলেই সে হাঁচিয়া কাশিয়া অস্থির হইয়া উঠে , কিন্তু সে স্থির ধীর বিচক্ষণ । সে তাহার আইনের বইয়ের যে অধ্যায়টি পড়িতেছিল সেইটেকে টেবিলের উপর খোলা অবস্থায় উপুড় করিয়া রাখিয়া কিরণকে বলিল , “ এ পাগলামি ছাড়া আর-কিছুই নহে । ” কিরণ অত্যন্ত উদ্‌বেগের সহিত মাথা নাড়িয়া কহিল, “জান তো ঠাকুরপো? তোমার দাদা যখন ভালো আছেন তখন বেশ আছেন, কিন্তু একবার যদি খ্যাপেন তবে তাঁহাকে কেহ সামলাইতে পারে না। আমি কী করি বলো তো।”
পরিবারের সকল প্রকৃতিস্থ লোকের সঙ্গেই যখন কিরণের মতের সম্পূর্ণ মিল হইল তখন সেইটেই বনোয়ারির বুকে সকলের চেয়ে বাজিল। এই একটুখানি স্ত্রীলোক , অনতিস্ফুট চাঁপাফুলটির মতো পেলব , ইহার হৃদয়টিকে আপন বেদনার কাছে টানিয়া আনিতে পুরুষের সমস্ত শক্তি পরাস্ত হইল। আজকের দিনে কিরণ যদি বনোয়ারির সহিত সম্পূর্ণ মিলিতে পারিত তবে তাহার হৃদয়ক্ষত দেখিতে দেখিতে এমন করিয়া বাড়িয়া উঠিত না।

মধুকে রক্ষা করিতে হইবে এই অতি সহজ কর্তব্যের কথাটা, চারি দিক হইতে তাড়নার চোটে, বনোয়ারির পক্ষে সত্য-সত্যই একটা খ্যাপামির ব্যাপার হইয়া উঠিল । ইহার তুলনায় অন্য সমস্ত কথাই তাহার কাছে তুচ্ছ হইয়া গেল। এ দিকে জেল হইতে নীলকণ্ঠ এমন সুস্থভাবে ফিরিয়া আসিল যেন সে জামাইষষ্ঠীর নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিল। আবার সে যথারীতি অম্লানবদনে আপনার কাজে লাগিয়া গেল।

মধুকে ভিটাছাড়া করিতে না পারিলে প্রজাদের কাছে নীলকণ্ঠের মান রক্ষা হয় না। মানের জন্য সে বেশি কিছু ভাবে না , কিন্তু প্রজারা তাহাকে না মানিলে তাহার কাজ চলিবে না, এইজন্যই তাহাকে সাবধান হইতে হয়। তাই মধুকে তৃণের মতো উৎপাটিত করিবার জন্য তাহার নিড়ানিতে শান দেওয়া শুরু হইল।

এবার বনোয়ারি আর গোপনে রহিল না। এবার সে নীলকণ্ঠকে স্পষ্টই জানাইয়া দিল যে, যেমন করিয়া হউক মধুকে উচ্ছেদ হইতে সে দিবে না । প্রথমত , মধুর দেনা সে নিজে হইতে সমস্ত শোধ করিয়া দিল; তাহার পরে আর-কোনো উপায় না দেখিয়া সে নিজে গিয়া ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাইয়া আসিল যে, নীলকণ্ঠ অন্যায় করিয়া মধুকে বিপদে ফেলিবার উদ্‌যোগ করিতেছে।

হিতৈষীরা বনোয়ারিকে সকলেই বুঝাইল, যেরূপ কাণ্ড ঘটিতেছে তাহাতে কোন্‌দিন মনোহর তাহাকে ত্যাগ করিবে । ত্যাগ করিতে গেলে যে-সব উৎপাত পোহাইতে হয় তাহা যদি না থাকিত তবে এতদিনে মনোহর তাহাকে বিদায় করিয়া দিত। কিন্তু , বনোয়ারির মা আছেন এবং আত্মীয়স্বজনের নানা লোকের নানা প্রকার মত , এই লইয়া একটা গোলমাল বাধাইয়া তুলিতে তিনি অত্যন্ত অনিচ্ছুক বলিয়াই এখনো মনোহর চুপ করিয়া আছেন ।

এমনি হইতে হইতে একদিন সকালে হঠাৎ দেখা গেল , মধুর ঘরে তালা বন্ধ । রাতারাতি সে যে কোথায় গিয়াছে তাহার খবর নাই। ব্যাপারটা নিতান্ত অশোভন হইতেছে দেখিয়া নীলকণ্ঠ জমিদার-সরকার হইতে টাকা দিয়া তাহাকে সপরিবারে কাশী পাঠাইয়া দিয়াছে। পুলিস তাহা জানে; এজন্য কোনো গোলমাল হইল না। অথচ নীলকণ্ঠ কৌশলে গুজব রটাইয়া দিল যে , মধুকে তাহার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসমেত অমাবস্যা-রাত্রে কালীর কাছে বলি দিয়া মৃতদেহগুলি ছালায় পুরিয়া মাঝগঙ্গায় ডুবাইয়া দেওয়া হইয়াছে। ভয়ে সকলের শরীর শিহরিয়া উঠিল এবং নীলকণ্ঠের প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা পূর্বের চেয়ে অনেক পরিমাণে বাড়িয়া গেল।

বনোয়ারি যাহা লইয়া মাতিয়া ছিল উপস্থিতমত তাহার শান্তি হইল। কিন্তু সংসারটি তাহার কাছে আর পূর্বেই মতো রহিল না।

বংশীকে একদিন বনোয়ারি অত্যন্ত ভলোবাসিত; আজ দেখিল বংশী তাহার কেহ নহে, সে হালদারগোষ্ঠীর । আর , তাহার কিরণ , যাহার ধ্যানরূপটি যৌবনারম্ভের পূর্ব হইতে ক্রমে ক্রমে তাহার হৃদয়ের লতাবিতানটিকে জড়াইয়া জড়াইয়া আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে , সেও সম্পূর্ণ তাহার নহে , সেও হালদারগোষ্ঠীর । একদিন ছিল যখন নীলকণ্ঠের ফরমাশে-গড়া গহনা তাহার এই হৃদয়বিহারিণী কিরণের গায়ে ঠিকমত মানাইত না বলিয়া বনোয়ারি খুঁতখুঁত করিত। আজ দেখিল , কালিদাস হইতে আরম্ভ করিয়া অমরু ও চৌর কবির যে-সমস্ত কবিতার সোহাগে সে প্রেয়সীকে মণ্ডিত করিয়া আসিয়াছে আজ তাহা এই হালদারগোষ্ঠীর বড়োবউকে কিছুতেই মানাইতেছে না ।
হায় রে , বসন্তের হাওয়া তবু বহে , রাত্রে শ্রাবণের বর্ষণ তবু মুখরিত হইয়া উঠে এবং অতৃপ্ত প্রেমের বেদনা শূন্য হৃদয়ের পথে পথে কাঁদিয়া কাঁদিয়া বেড়ায় ।

প্রেমের নিবিড়তায় সকলের তো প্রয়োজন নাই ; সংসারের ছোটো কুন্‌‍‌কের মাপের বাঁধা বরাদ্দে অধিকাংশ লোকের বেশ চলিয়া যায় । সেই পরিমিত ব্যবস্থায় বৃহৎ সংসারে কোনো উৎপাত ঘটে না । কিন্তু , এক-একজনের ইহাতে কুলায় না । তাহারা অজাত পক্ষীশাবকের মতো কেবলমাত্র ডিমের ভিতরকার সংকীর্ণ খাদ্যরসটুকু লইয়া বাঁচে না , তাহারা ডিম ভাঙিয়া বাহির হইয়াছে , নিজের শক্তিতে খাদ্য আহরণের বৃহৎ ক্ষেত্র তাহাদের চাই। বনোয়ারি সেই ক্ষুধা লইয়া জন্মিয়াছে , নিজের প্রেমকে নিজের পৌরুষের দ্বারা সার্থক করিবার জন্য তাহার চিত্ত উৎসুক, কিন্তু যেদিকেই সে ছুটিতে চায় সেইদিকেই হালদারগোষ্ঠীর পাকা ভিত ; নড়িতে গেলেই তাহার মাথা ঠুকিয়া যায় ।

দিন আবার পূর্বের মতো কাটিতে লাগিল । আগের চেয়ে বনোয়ারি শিকারে বেশি মন দিয়াছে , ইহা ছাড়া বাহিরের দিক হইতে তাহার জীবনে আর বিশেষ কিছু পরিবর্তন দেখা গেল না । অন্তঃপুরে সে আহার করিতে যায় , আহারের পর স্ত্রীর সঙ্গে যথাপরিমাণে বাক্যালাপও হয় । মধুকৈবর্তকে কিরণ আজও ক্ষমা করে নাই , কেননা , এই পরিবারে তাহার স্বামী যে আপন প্রতিষ্ঠা হারাইয়াছে তাহার মূল কারণ মধু । এইজন্য ক্ষণে ক্ষণে কেমন করিয়া সেই মধুর কথা অত্যন্ত তীব্র হইয়া কিরণের মুখে আসিয়া পড়ে । মধুর যে হাড়ে হাড়ে বজ্জাতি , সে যে শয়তানের অগ্রগণ্য , এবং মধুকে দয়া করাটা যে নিতান্তই একটা ঠকা , এ কথা বার বার বিস্তারিত করিয়াও কিছুতে তাহার শান্তি হয় না । বনোয়ারি প্রথম দুই-একদিন প্রতিবাদের চেষ্টা করিয়া কিরণের উত্তেজনা প্রবল করিয়া তুলিয়াছিল , তাহার পর হইতে সে কিছুমাত্র প্রতিবাদ করে না । এমনি করিয়া বনোয়ারি তাহার নিয়মিত গৃহধর্ম রক্ষা করিতেছে ; কিরণ ইহাতে কোনো অভাব-অসম্পূর্ণতা অনুভব করে না , কিন্তু ভিতরে ভিতরে বনোয়ারির জীবনটা বিবর্ণ , বিরস এবং চির-অভুক্ত ।

এমন সময় জানা গেল বাড়ির ছোটোবউ , বংশীর স্ত্রী গর্ভিণী । সমস্ত পরিবার আশায় উৎফুল্ল হইয়া উঠিল । কিরণের দ্বারা এই মহদ্‌বংশের প্রতি যে কর্তব্যের ত্রুটি হইয়াছিল , এতদিন পরে তাহা পূরণের সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে ; এখন ষষ্ঠীর কৃপায় কন্যা না হইয়া পুত্র হইলে রক্ষা ।

পুত্রই জন্মিল । ছোটোবাবু কলেজের পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ , বংশের পরীক্ষাতেও প্রথম মার্ক পাইল । তাহার আদর উত্তরোত্তর বাড়িয়া উঠিতেছিল , এখন তাহার আদরের সীমা রহিল না ।

সকলে মিলিয়া এই ছেলেটিকে লইয়া পড়িল । কিরণ তো তাহাকে এক মুহূর্ত কোল হইতে নামাইতে চায় না । তাহার এমন অবস্থা যে , মধুকৈবর্তের স্বভাবের কুটিলতার কথাও সে প্রায় বিস্মৃত হইবার জো হইল ।

বনোয়ারির ছেলে-ভালোবাসা অত্যন্ত প্রবল । যাহা কিছু ছোটো , অক্ষম , সুকুমার, তাহার প্রতি তাহার গভীর স্নেহ এবং করুণা । সকল মানুষেরই প্রকৃতির মধ্যে বিধাতা এমন একটা-কিছু দেন যাহা তাহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ, নহিলে বনোয়ারি যে কেমন করিয়া পাখি শিকার করিতে পারে বোঝা যায় না ।

কিরণের কোলে একটি শিশুর উদয় দেখিবে , এই ইচ্ছা বনোয়ারির মনে বহুকাল হইতে অতৃপ্ত হইয়া আছে । এইজন্য বংশীর ছেলে হইলে প্রথমটা তাহার মনে একটু ঈর্ষার বেদনা জন্মিয়াছিল , কিন্তু সেটাকে দূর করিয়া দিতে তাহার বিলম্ব হয় নাই । এই শিশুটিকে বনোয়ারি খুবই ভালোবাসিতে পারিত , কিন্তু ব্যাঘাতের কারণ হইল এই যে , যত দিন যাইতে লাগিল কিরণ তাহাকে লইয়া অত্যন্ত বেশি ব্যাপৃত হইয়া পড়িল । স্ত্রীর সঙ্গে বনোয়ারির মিলনে বিস্তর ফাঁক পড়িতে লাগিল । বনোয়ারি স্পষ্টই বুঝিতে পারিল , এতদিন পরে কিরণ এমন একটা-কিছু পাইয়াছে যাহা তাহার হৃদয়কে সত্যসত্যই পূর্ণ করিতে পারে । বনোয়ারি যেন তাহার স্ত্রীর হৃদয়হর্ম্যের একজন ভাড়াটে, যতদিন বাড়ির কর্তা অনুপস্থিত ছিল ততদিন সমস্ত বাড়িটা সে ভোগ করিত , কেহ বাধা দিত না, এখন গৃহস্বামী আসিয়াছে তাই ভাড়াটে সব ছাড়িয়া তাহার কোণের ঘরটি মাত্র দখল করিতে অধিকারী । কিরণ স্নেহে যে কতদূর তন্ময় হইতে পারে , তাহার আত্মবিসর্জনের শক্তি যে কত প্রবল , তাহা বনোয়ারি যখন দেখিল তখন তাহার মন মাথা নাড়িয়া বলিল , ‘ এই হৃদয়কে আমি তো জাগাইতে পারি নাই , অথচ আমার যাহা সাধ্য তাহা তো করিয়াছি । ‘
শুধু তাই নয় , এই ছেলেটির সূত্রে বংশীর ঘরই যেন কিরণের কাছে বেশি আপন হইয়া উঠিয়াছে । তাহার সমস্ত মন্ত্রণা আলোচনা বংশীর সঙ্গেই ভালো করিয়া জমে । সেই সূক্ষ্মবুদ্ধি সূক্ষ্মশরীর রসরক্তহীন ক্ষীণজীবী ভীরু মানুষটার প্রতি বনোয়ারির অবজ্ঞা ক্রমেই গভীরতর হইতেছিল । সংসারের সকল লোকে তাহাকেই বনোয়ারির চেয়ে সকল বিষয়ে যোগ্য বলিয়া মনে করে তাহা বনোয়ারির সহিয়াছে, কিন্তু আজ সে যখন বার বার দেখিল, মানুষ হিসাবে তাহার স্ত্রীর কাছে বংশীর মূল্য বেশি , তখন নিজের ভাগ্য এবং বিশ্বসংসারের প্রতি তাহার মন প্রসন্ন হইল না ।

এমন সময়ে পরীক্ষার কাছাকাছি কলিকাতার বাসা হইতে খবর আসিল , বংশী জ্বরে পড়িয়াছে এবং ডাক্তার আরোগ্য অসাধ্য বলিয়া আশঙ্কা করিতেছে । বনোয়ারি কলিকাতায় গিয়া দিনরাত জাগিয়া বংশীর সেবা করিল , কিন্তু তাহাকে বাঁচাইতে পারিল না ।

মৃত্যু বনোয়ারির স্মৃতি হইতে সমস্ত কাঁটা উৎপাটিত করিয়া লইল । বংশী যে তাহার ছোটো ভাই এবং শিশুবয়সে দাদার কোলে যে তাহার স্নেহের আশ্রয় ছিল , এই কথাই তাহার মনে অশ্রুধৌত হইয়া উজ্জ্বল হইয়া উঠিল ।

এবার ফিরিয়া আসিয়া তাহার সমস্ত প্রাণের যত্ন দিয়া শিশুটিকে মানুষ করিতে সে কৃতসংকল্প হইল। কিন্তু, এই শিশু সম্বন্ধে কিরণ তাহার প্রতি বিশ্বাস হারাইয়াছে। ইহার প্রতি তাহার স্বামীর বিরাগ সে প্রথম হইতেই লক্ষ করিয়াছে। স্বামীর সম্বন্ধে কিরণের মনে কেমন ধারণা হইয়া গেছে যে, অপর সাধারণের পক্ষে যাহা স্বাভাবিক তাহার স্বামীর পক্ষে ঠিক তাহার উল্ টা। তাহাদের বংশের এই তো একমাত্র কুলপ্রদীপ , ইহার মূল্য যে কী তাহা আর-সকলেই বোঝে , নিশ্চয় সেইজন্যই তাহার স্বামী তাহা বোঝে না । কিরণের মনে সর্বদাই ভয় , পাছে বনোয়ারির বিদ্বেষদৃষ্টি ছেলেটির অমঙ্গল ঘটায়। তাহার দেবর বাঁচিয়া নাই, কিরণের সন্তানসম্ভাবনা আছে বলিয়া কেহই আশা করে না , অতএব এই শিশুটিকে কোনোমতে সকল প্রকার অকল্যাণ হইতে বাঁচাইয়া রাখিতে পারিলে তবে রক্ষা । এইরূপে বংশীর ছেলেটিকে যত্ন করিবার পথ বনোয়ারির পক্ষে বেশ স্বাভাবিক হইল না ।

বাড়ির সকলের আদরে ক্রমে ছেলেটি বড়ো হইয়া উঠিতে লাগিল । তাহার নাম হইল হরিদাস । এত বেশি আদরের আওতায় সে যেন কেমন ক্ষীণ এবং ক্ষণভঙ্গুর আকার ধারণ করিল । তাগা-তাবিজ-মাদুলিতে তাহার সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন , রক্ষকের দল সর্বদাই তাহাকে ঘিরিয়া ।

ইহার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে বনোয়ারির সঙ্গে তাহার দেখা হয় । জ্যাঠামশায়ের ঘোড়ায় চড়িবার চাবুক লইয়া আস্ফালন করিতে সে বড়ো ভালোবসে । দেখা হইলেই বলে ‘ চাবু ‘ । বনোয়ারি ঘর হইতে চাবুক বাহির করিয়া আনিয়া বাতাসে সাঁই সাঁই শব্দ করিতে থাকে , তাহার ভারি আনন্দ হয় । বনোয়ারি এক-একদিন তাহাকে আপনার ঘোড়ার উপর বসাইয়া দেয় , তাহাতে বাড়িসুদ্ধ লোক একেবারে হাঁ-হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসে । বনোয়ারি কখনো কখনো আপনার বন্দুক লইয়া তাহার সঙ্গে খেলা করে , দেখিতে পাইলে কিরণ ছুটিয়া আসিয়া বালককে সরাইয়া লইয়া যায় । কিন্তু , এই-সকল নিষিদ্ধ আমোদেই হরিদাসের সকলের চেয়ে অনুরাগ । এইজন্য সকল প্রকার বিঘ্ন-সত্ত্বে জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে তাহার খুব ভাব হইল ।

বহুকাল অব্যাহতির পর এক সময়ে হঠাৎ এই পরিবারে মৃত্যুর আনাগোনা ঘটিল । প্রথমে মনোহরের স্ত্রীর মৃত্যু হইল । তাহার পরে নীলকণ্ঠ যখন কর্তার জন্য বিবাহের পরামর্শ ও পাত্রীর সন্ধান করিতেছে এমন সময় বিবাহের লগ্নের পূর্বেই মনোহরের মৃত্যু হইল । তখন হরিদাসের বয়স আট । মৃত্যুর পূর্বে মনোহর বিশেষ করিয়া তাঁহার ক্ষুদ্র এই বংশধরকে কিরণ এবং নীলকণ্ঠের হাতে সমর্পণ করিয়া গেলেন ; বনোয়ারিকে কোনো কথাই বলিলেন না ।
বাক্স হইতে উইল যখন বাহির হইল তখন দেখা গেল , মনোহর তাহার সমস্ত সম্পত্তি হরিদাসকে দিয়া গিয়াছেন। বনোয়ারি যাবজ্জীবন দুই শত টাকা করিয়া মাসহারা পাইবেন । নীলকণ্ঠ উইলের এক্‌জিক্যুটর; তাহার উপরে ভার রহিল , সে যতদিন বাঁচে, হালদার-পরিবারের বিষয় এবং সংসারের ব্যবস্থা সেই করিবে ।

বনোয়ারি বুঝিলেন, এ পরিবারে কেহ তাঁহাকে ছেলে দিয়াও ভরসা পায় না, বিষয় দিয়াও না। তিনি কিছুই পারেন না, সমস্তই নষ্ট করিয়া দেন , এ সম্বন্ধে এ বাড়িতে কাহারো দুই মত নাই । অতএব , তিনি বরাদ্দমত আহার করিয়া কোণের ঘরে নিদ্রা দিবেন , তাঁহার পক্ষে এইরূপ বিধান।

তিনি কিরণকে বলিলেন, “আমি নীলকণ্ঠের পেন্‌সন খাইয়া বাঁচিবে না। এ বাড়ি ছাড়িয়া চলো আমার সঙ্গে কলিকাতায়। ”

“ ওমা! সে কী কথা! এ তো তোমারই বাপের বিষয় , আর হরিদাস তো তোমারই আপনার ছেলের তুল্য । ওকে বিষয় লিখিয়া দেওয়া হইয়াছে বলিয়া তুমি রাগ কর কেন। ”

হায় হায়, তাহার স্বামীর হৃদয় কী কঠিন। এই কচি ছেলের উপরেও ঈর্ষা করিতে তাহার মন ওঠে? তাহার শ্বশুর যে উইলটি লিখিয়াছে কিরণ মনে মনে তাহার সম্পূর্ণ সমর্থন করে। তাহার নিশ্চয় বিশ্বাস, বনোয়ারির হাতে যদি বিষয় পড়িত তবে রাজ্যের যত ছোটোলোক , যত যদু মধু , যত কৈবর্ত এবং মুসলমান জোলার দল তাহাকে ঠকাইয়া কিছু আর বাকি রাখিত না এবং হালদার-বংশের এই ভাবী আশা একদিন অকূলে ভাসিত। শ্বশুরের কুলে বাতি জ্বালিবার দীপটি তো ঘরে আসিয়াছে, এখন তাহার তৈলসঞ্চয় যাহাতে নষ্ট না হয় নীলকণ্ঠই তো তাহার উপযুক্ত প্রহরী।

বনোয়ারি দেখিল , নীলকণ্ঠ অন্তঃপুরে আসিয়া ঘরে ঘরে সমস্ত জিনিসপত্রের লিস্ট করিতেছে এবং যেখানে যত সিন্দুক-বাক্স আছে তাহাতে তালাচাবি লাগাইতেছে । অবশেষে কিরণের শোবার ঘরে আসিয়া সে বনোয়ারির নিত্যব্যবহার্য সমস্ত দ্রব্য ফর্দভুক্ত করিতে লাগিল । নীলকণ্ঠের অন্তঃপুরে গতিবিধি আছে , সুতরাং কিরণ তাহাকে লজ্জা করে না । কিরণ শ্বশুরের শোকে ক্ষণে ক্ষণে অশ্রু মুছিবার অবকাশে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বিশেষ করিয়া সমস্ত জিনিস বুঝাইয়া দিতে লাগিল ।

বনোয়ারি সিংহগর্জনে গর্জিয়া উঠিয়া নীলকণ্ঠকে বলিল , “ তুমি এখনি আমার ঘর হইতে বাহির হইয়া যাও। ”

নীলকণ্ঠ নম্র হইয়া কহিল, “ বড়োবাবু, আমার তো কোনো দোষ নাই। কর্তার উইল-অনুসারে আমাকে তো সমস্ত বুঝিয়া লইতে হইবে। আসবাবপত্র সমস্তই তো হরিদাসের। ”

কিরণ মনে মনে কহিল, ‘দেখো একবার, ব্যাপারখানা দেখো। হরিদাস কি আমাদের পর। নিজের ছেলের সামগ্রী ভোগ করিতে আবার লজ্জা কিসের। আর, জিনিসপত্র মানুষের সঙ্গে যাইবে না কি। আজ না হয় কাল ছেলেপুলেরাই তো ভোগ করিবে। ‘

এ বাড়ির মেঝে বনোয়ারির পায়ের তলায় কাঁটার মতো বিঁধিতে লাগিল, এ বাড়ির দেয়াল তাহার দুই চক্ষুকে যেন দগ্ধ করিল। তাহার বেদনা যে কিসের তাহা বলিবার লোকও এই বৃহৎ পরিবারে কেহ নাই।

এই মুহূর্তেই বাড়িঘর সমস্ত ফেলিয়া বাহির হইয়া যাইবার জন্য বনোয়ারির মন ব্যাকুল হইয়া উঠিল । কিন্তু , তাহার রাগের জ্বালা যে থামিতে চায় না । সে চলিয়া যাইবে আর নীলকণ্ঠ আরামে একাধিপত্য করিবে, এ কল্পনা সে সহ্য করিতে পারিল না। এখনি কোনো-একটা গুরুতর অনিষ্ট করিতে না পারিলে তাহার মন শান্ত হইতে পারিতেছে না । সে বলিল, ‘ নীলকণ্ঠ কেমন বিষয় রক্ষা করিতে পারে আমি তাহা দেখিব। ‘

বাহিরে তাহার পিতার ঘরে গিয়া দেখিল , সে ঘরে কেহই নাই। সকলেই অন্তঃপুরের তৈজসপত্র ও গহনা প্রভৃতির খবরদারি করিতে গিয়াছে। অত্যন্ত সাবধান লোকেরও সাবধানতায় ত্রুটি থাকিয়া যায় । নীলকণ্ঠের হুঁশ ছিল না যে, কর্তার বাক্স খুলিয়া উইল বাহির করিবার পরে বাক্সয় চাবি লাগানো হয় নাই। সেই বাক্সয় তাড়াবাঁধা মূল্যমান সমস্ত দলিল ছিল। সেই দলিলগুলির উপরেই এই হালদার-বংশের সম্পত্তির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত।

বনোয়ারি এই দলিলগুলির বিবরণ কিছুই জানে না , কিন্তু এগুলি যে অত্যন্ত কাজের এবং ইহাদের অভাবে মামলা-মকদ্দমায় পদে পদে ঠকিতে হইবে তাহা সে বোঝে । কাগজগুলি লইয়া সে নিজের একটি রুমালে জড়াইয়া তাহাদের বাহিরের বাগানে চাঁপাতলায় বাঁধানো চাতালে বসিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া ভাবিতে লাগিল ।

পরদিন শ্রাদ্ধ সম্বন্ধে অলোচনা করিবার জন্য নীলকণ্ঠ বনোয়ারির কাছে উপস্থিত হইল । নীলকণ্ঠের দেহের ভঙ্গি অত্যন্ত বিনম্র , কিন্তু তাহার মুখের মধ্যে এমন একটা-কিছু ছিল , অথবা ছিল না , যাহা দেখিয়া অথবা কল্পনা করিয়া বনোয়ারির পিত্ত জ্বলিয়া গেল । তাহার মনে হইল , নম্রতার দ্বারা নীলকণ্ঠ তাহাকে ব্যঙ্গ করিতেছে ।

নীলকণ্ঠ বলিল , “ কর্তার শ্রাদ্ধ সম্বন্ধে —”

বনোয়ারি তাহাকে কথা শেষ করিতে না দিয়াই বলিয়া উঠিল, “ আমি তাহার কী জানি। ”

নীলকণ্ঠ কহিল , “ সে কী কথা । আপনিই তো শ্রাদ্ধাধিকারী । ”

‘ মস্ত অধিকার! শ্রাদ্ধের অধিকার! সংসারে কেবল ঐটুকুতে আমার প্রয়োজন আছে — আমি আর কোনো কাজেরই না । ‘ বনোয়ারি গর্জিয়া উঠিল , “ যাও, যাও, আমাকে বিরক্ত করিয়ো না । ”

নীলকণ্ঠ গেল কিন্তু তাহার পিছন হইতে বনোয়ারির মনে হইল , সে হাসিতে হাসিতে গেল। বনোয়ারির মনে হইল, বাড়ির সমস্ত চাকরবাকর এই অশ্রদ্ধিত , এই পরিত্যক্তকে লইয়া আপনাদের মধ্যে হাসিতামাশা করিতেছে। যে মানুষ বাড়ির অথচ বাড়ির নহে , তাহার মতো ভাগ্যকর্তৃক পরিহসিত আর কে আছে। পথের ভিক্ষুকও নহে ।

বনোয়ারি সেই দলিলের তাড়া লইয়া বাহির হইল। হালদার-পরিবারের প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী জমিদার ছিল প্রতাপপুরের বাঁড়ুজ্যে জমিদারেরা। বনোয়ারি স্থির করিল , ‘এই দলিল-দস্তাবেজ তাহাদের হাতে দিব, বিষয়সম্পত্তি সমস্ত ছারখার হইয়া যাক। ‘

বাহির হইবার সময় হরিদাস উপরের তলা হইতে তাহার সুমধুর বালককণ্ঠে চীৎকার করিয়া উঠিয়া কহিল , “ জ্যাঠামশায় , তুমি বাহিরে যাইতেছ , আমিও তোমার সঙ্গে বাহিরে যাইব। ”

বনোয়ারির মনে হইল, ‘বালকের অশুভগ্রহ এই কথা তাহাকে দিয়া বলাইয়া লইল। আমি তো পথে বাহির হইয়াছি, উহাকেও আমার সঙ্গে বাহির করিব । যাবে যাবে, সব ছারখার হইবে। ‘

বাহিরের বাগান পর্যন্ত যাইতেই বনোয়ারি একটা বিষম গোলমাল শুনিতে পাইল। অদূরে হাটের সংলগ্ন একটি বিধবার কুটিরে আগুন লাগিয়াছে । বনোয়ারির চিরাভ্যাসক্রমে এ দৃশ্য দেখিয়া সে আর স্থির থাকিতে পারিল না। তাহার দলিলের তাড়া সে চাঁপাতলায় রাখিয়া আগুনের কাছে ছুটিল।

যখন ফিরিয়া আসিল , দেখিল , তাহার সেই কাগজের তাড়া নাই । মুহূর্তের মধ্যে হৃদয়ে শেল বিঁধাইয়া এই কথাটা মনে হইল, ‘ নীলকণ্ঠের কাছে আবার আমার হার হইল । বিধবার ঘর জ্বালিয়া ছাই হইয়া গেলে তাহাতে ক্ষতি কী ছিল । ‘ তাহার মনে হইল , চতুর নীলকণ্ঠই ওটা পুনর্বার সংগ্রহ করিয়াছে ।

একেবারে ঝড়ের মতো সে কাছারিঘরে আসিয়া উপস্থিত। নীলকণ্ঠ তাড়াতাড়ি বাক্স বন্ধ করিয়া সসম্ভ্রমে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বনোয়ারিকে প্রণাম করিল । বনোয়ারির মনে হইল , ঐ বাক্সের মধ্যেই সে কাগজ লুকাইল । কোনো-কিছু না বলিয়া একেবারে সেই বাক্সটা খুলিয়া তাহার মধ্যে কাগজ ঘাঁটিতে লাগিল। তাহার মধ্যে হিসাবের খাতা এবং তাহারই জোগাড়ের সমস্ত নথি। বাক্স উপুড় করিয়া ঝাড়িয়া কিছুই মিলিল না ।
রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বনোয়ারি কহিল, “তুমি চাঁপাতলায় গিয়াছিলে?”

নীলকণ্ঠ বলিল , “ আজ্ঞা হাঁ , গিয়াছিলাম বৈকি । দেখিলাম , আপনি ব্যস্ত হইয়া ছুটিতেছেন, কী হইল তাহাই জানিবার জন্য বাহির হইয়াছিলাম। ”

বনোয়ারি। আমার রুমালে-বাঁধা কাগজগুলা তুমিই লইয়াছ ।

নীলকণ্ঠ নিতান্ত ভালোমানুষের মতো কহিল, “ আজ্ঞা , না । ”

বনোয়ারি । মিথ্যা কথা বলিতেছ । তোমার ভালো হইবে না , এখনি ফিরাইয়া দাও ।

বনোয়ারি মিথ্যা তর্জন গর্জন করিল । কী জিনিস তাহার হারাইয়াছে তাহাও সে বলিতে পারিল না এবং সেই চোরাই মাল সম্বন্ধে তাহার কোনো জোর নাই জানিয়া সে মনে মনে অসাবধান মূঢ় আপনাকেই যেন ছিন্ন ছিন্ন করিতে লাগিল ।

কাছারিতে এইরূপ পাগলামি করিয়া সে চাঁপাতলায় আবার খোঁজাখুঁজি করিতে লাগিল। মনে মনে মাতৃদিব্য করিয়া সে প্রতিজ্ঞা করিল, ‘ যে করিয়া হউক এ কাগজগুলা পুনরায় উদ্ধার করিব তবে আমি ছাড়িব। ‘ কেমন করিয়া উদ্ধার করিবে তাহা চিন্তা করিবার সামর্থ্য তাহার ছিল না, কেবল ক্রুদ্ধ বালকের মতো বার বার মাটিতে পদাঘাত করিতে করিতে বলিল, ‘ উদ্ধার করিবই , করিবই , করিবই। ‘

শ্রান্তদেহে সে গাছতলায় বসিল । কেহ নাই , তাহার কেহ নাই এবং তাহার কিছুই নাই। এখন হইতে নিঃসম্বলে আপন ভাগ্যের সঙ্গে এবং সংসারের সঙ্গে তাহাকে লড়াই করিতে হইবে। তাহার পক্ষে মানসম্ভ্রম নাই , ভদ্রতা নাই , প্রেম নাই , স্নেহ নাই , কিছুই নাই । আছে কেবল মরিবার এবং মারিবার অধ্যবসায়।

এইরূপ মনে মনে ছট্‌ফট্‌ করিতে করিতে নিরতিশয় ক্লান্তিতে চাতালের উপর পড়িয়া কখন সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। যখন জাগিয়া উঠিল তখন হঠাৎ বুঝিতে পারিল না, কোথায় সে আছে। ভালো করিয়া সজাগ হইয়া উঠিয়া বসিয়া দেখে তাহার শিয়রের কাছে হরিদাস বসিয়া। বনোয়ারিকে জাগিতে দেখিয়া হরিদাস বলিয়া উঠিল, “ জ্যাঠামশায় , তোমার কী হারাইয়াছে বলো দেখি। ”

বনোয়ারি স্তব্ধ হইয়া গেল। হরিদাসের এ প্রশ্নের উত্তর করিতে পারিল না ।

হরিদাস কহিল, “ আমি যদি দিতে পারি আমাকে কী দিবে। ”

বনোয়ারির মনে হইল , হয়তো আর-কিছু । সে বলিল, “ আমার যাহা আছে সব তোকে দিব। ”

এ কথা সে পরিহাস করিয়াই বলিল ; সে জানে , তাহার কিছুই নাই ।

তখন হরিদাস আপন কাপড়ের ভিতর হইতে বনোয়ারির রুমালে-মোড়া সেই কাগজের তাড়া বাহির করিল। এই রঙিন রুমালটাতে বাঘের ছবি আঁকা ছিল ; সেই ছবি তাহার জ্যাঠা তাহাকে অনেকবার দেখাইয়াছে। এই রুমালটার প্রতি হরিদাসের বিশেষ লোভ। সেইজন্যেই অগ্নিদাহের গোলমালে ভৃত্যেরা যখন বাহিরে ছুটিয়াছিল সেই অবকাশে বাগানে আসিয়া হরিদাস চাঁপাতলায় দূর হইতে এই রুমালটা দেখিয়াই চিনিতে পারিয়াছিল।

হরিদাসকে বনোয়ারি বুকের কাছে টানিয়া লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল; কিছুক্ষণ পরে তাহার চোখ দিয়া ঝর্‌ ঝর্‌ করিয়া জল পড়িতে লাগিল। তাহার মনে পড়িল , অনেকদিন পূর্বে সে তাহার এক নূতন-কেনা কুকুরকে শায়েস্তা করিবার জন্য তাহাকে বার বার চাবুক মারিতে বাধ্য হইয়াছিল । একবার তাহার চাবুক হারাইয়া গিয়াছিল , কোথাও সে খুঁজিয়া পাইতেছিল না। যখন চাবুকের আশা পরিত্যাগ করিয়া সে বসিয়া আছে এমন সময় দেখিল, সেই কুকুরটা কোথা হইতে চাবুকটা মুখে করিয়া মনিবের সম্মুখে আনিয়া পরমানন্দে লেজ নাড়িতেছে। আর-কোনোদিন কুকুরকে সে চাবুক মারিতে পারে নাই।
বনোয়ারি তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া ফেলিয়া কহিল, “ হরিদাস, তুই কী চাস্ আমাকে বল্‌। ”

হরিদাস কহিল , “ আমি তোমার ঐ রুমালটা চাই , জ্যাঠামশায় । ”

বনোয়ারি কহিল , “ আয় হরিদাস , তোকে কাঁধে চড়াই । ”

হরিদাসকে কাঁধে তুলিয়া লইয়া বনোয়ারি তৎক্ষণাৎ অন্তঃপুরে চলিয়া গেল। শয়নঘরে গিয়া দেখিল, কিরণ সারাদিন-রৌদ্রে-দেওয়া কম্বলখানি বারান্দা হইতে তুলিয়া আনিয়া ঘরের মেজের উপর পাতিতেছে। বনোয়ারির কাঁধের উপর হরিদাসকে দেখিয়া সে উদ্‌বিগ্ন হইয়া বলিয়া উঠিল, “নামাইয়া দাও , নামাইয়া দাও। উহাকে তুমি ফেলিয়া দিবে । ”

বনোয়ারি কিরণের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি রাখিয়া কহিল, “ আমাকে আর ভয় করিয়ো না , আমি ফেলিয়া দিব না । ”

এই বলিয়া সে কাঁধ হইতে নামাইয়া হরিদাসকে কিরণের কোলের কাছে অগ্রসর করিয়া দিল । তাহার পরে সেই কাগজগুলি লইয়া কিরণের হাতে দিয়া কহিল , “ এগুলি হরিদাসের বিষয়সম্পত্তির দলিল । যত্ন করিয়া রাখিয়ো। ”

কিরণ আশ্চর্য হইয়া কহিল , “ তুমি কোথা হইতে পাইলে। ”

বনোয়ারি কহিল , “ আমি চুরি করিয়াছিলাম । ”

তাহার পর হরিদাসকে বুকে টানিয়া কহিল, “এই নে বাবা , তোর জ্যাঠামশায়ের যে মূল্যবান সম্পত্তিটির প্রতি তোর লোভ পড়িয়াছে , এই নে । ”

বলিয়া রুমালটি তাহার হাতে দিল ।

তাহার পর আর-একবার ভালো করিয়া কিরণের দিকে তাকাইয়া দেখিল । দেখিল , সেই তন্বী এখন তো তন্বী নাই, কখন মোটা হইয়াছে সে তাহা লক্ষ্য করে নাই । এতদিনে হালদারগোষ্ঠীর বড়োবউয়ের উপযুক্ত চেহারা তাহার ভরিয়া উঠিয়াছে । আর কেন , এখন অমরুশতকের কবিতাগুলাও বনোয়ারির অন্য সমস্ত সম্পত্তির সঙ্গে বিসর্জন দেওয়াই ভালো ।

সেই রাত্রেই বনোয়ারির আর দেখা নাই । কেবল সে একছত্র চিঠি লিখিয়া গেছে যে , সে চাকরি খুঁজিতে বাহির হইল ।

বাপের শ্রাদ্ধ পর্যন্ত সে অপেক্ষা করিল না! দেশসুদ্ধ লোক তাই লইয়া তাহাকে ধিক্‌ ধিক্‌ করিতে লাগিল ।


×

Alert message goes here

Plp file


Category
Utube fair

pixelLab দিয়ে নিজের নাম ডিজাইন ও Mocup

Paid hack

App link topup